বিজ্ঞাপন স্থান

কমলনগরের সাবেক চেয়ারম্যান আশরাফ উদ্দিনের দুঃখগাঁথা ফেরারী জীবন

ছিলেন সৎ, নিষ্ঠাবান ও গরীবের বন্ধু চেয়ারম্যান। কিন্তু স্বার্থন্বেষী কিছু মানুষের অপপ্রচারেই তার সুনাম কালিমালিপ্ত হয়। মিথ্যা অভিযোগে ঘুষ না দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে সাজানো মামলা হয়। বারবার তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও মামলা ঝুলিয়ে রেখে তাকে হয়রানি করা হয়। ফলে পরিবার ভেঙে যায়, বাবা-মা চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান, স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে যায়। জনগণের সেবা করতে গিয়ে আজ তিনি সমাজের চোখে অপরাধী, কাটাচ্ছেন ফেরারী জীবন। আক্ষেপ—সততার বিনিময়ে পেলেন অপবাদ, দুঃখ আর নিঃস্ব জীবন। আজকের সংবাদে এমনি একজন মানুষের কথা বলবো-

পল্লী চিকিৎসা আর সাংবাদিকতার মধ্য দিয়েই মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন আশরাফ উদ্দিন। সামাজিক সমস্যায় তিনি সবসময় সরব ছিলেন। বিশেষ করে মেঘনার নদীভাঙন রোধ আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রণী কর্মী। ভাঙনের শিকার অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বুঝেছিলেন—দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো জনপ্রতিনিধি হয়ে সরাসরি সরকারি সুবিধা পৌঁছে দেওয়া। সেই চিন্তা থেকেই রাজনীতির ময়দানে আসা।

সাইকেল আর মাইক হাতে প্রচারণা

গ্রামের সাধারণ কৃষক, শ্রমিক আর জেলেদের নিয়ে ভিন্নধর্মী নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছিলেন আশরাফ। তার ছিল না কোনো অর্থবহুল শোডাউন বা প্রভাবশালী এজেন্ট। নিজেই সাইকেল চালিয়ে, হাতে মাইক নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন। সাধারণ মানুষও স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার হয়ে প্রচারণায় অংশ নেন। শেষ পর্যন্ত বিপুল ভোটে জয়ী হন লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগর উপজেলার চরফলকন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে।

চেয়ারম্যান হওয়ার পর আশরাফ উদ্দিন প্রচলিত ধ্যান-ধারণা বদলে দেন। হাতে থাকত একটি ছোট ব্যাগ, যেখানে ইউনিয়ন পরিষদের সিল আর প্যাড রাখা থাকত। মানুষের দরজায় দরজায় গিয়ে সরকারি কাজ করে দিতেন তিনি। বাজারে বা রাস্তায় যেখানেই দেখা যেত, সেখানেই কাগজপত্রে স্বাক্ষর করতেন। দ্রুতই তিনি ‘গরীবের বন্ধু’ এবং ‘জনবান্ধব চেয়ারম্যান’ হিসেবে পরিচিতি পান।

২০১৫ সালে জেলার শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যানের পুরস্কারও অর্জন করেন। যদিও কোনো রাজনৈতিক দলে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না, তবে বিএনপির প্রতি তার সমর্থন ছিল প্রকাশ্য।

চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের সময় জনপ্রিয়তার শিখরে থাকলেও ব্যক্তিজীবনে নেমে আসে অন্ধকার। দারিদ্র্য আর মামলার বোঝা সহ্য করতে না পেরে স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যান, সন্তানকে দিয়ে যান নানার বাড়িতে। চিকিৎসার অভাবে বাবা-মাও মারা যান। বর্তমানে বরগুনায় একটি এনজিওতে স্বল্প বেতনে কাজ করেন আশরাফ।

তার জীবন এখন মামলার হাজিরায় কাটে। বরগুনা থেকে নোয়াখালী পর্যন্ত প্রায় হাজার কিলোমিটার পথ তাকে বারবার পাড়ি দিতে হয়। ইতোমধ্যেই ৪৪ বার আদালতে হাজিরা দিয়েছেন। প্রতিবার ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়, যা তার সামর্থ্যের বহু গুণ বেশি।

ভিজিএফ চাল বিতরণ বিতর্ক

২০১২-১৩ অর্থবছরে ইউনিয়নের ৬৩০ জন জেলের জন্য ৭৫ মেট্রিক টনেরও বেশি ভিজিএফ চাল বরাদ্দ আসে। সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্যরা সবাই আলাদা তালিকা জমা দেন। এতে নামের পুনরাবৃত্তি ঘটে। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উপস্থিতিতে তালিকা যাচাই করে সংশোধন করা হয় এবং সঠিকভাবে চাল বিতরণ হয়।

তবে ইউপি সদস্য ইব্রাহিম খলিল আশরাফের বিরুদ্ধে চাল আত্মসাতের অভিযোগ তোলেন। থানার ওসি, ইউএনও, প্রকৌশলীসহ একাধিক কর্মকর্তাকে দিয়ে ১২টি তদন্ত হয়। কোনো তদন্তেই অনিয়ম প্রমাণিত হয়নি, বরং আশরাফকে নির্দোষ বলা হয়।

দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলা

২০১৪ সালে আবার দুদকে অভিযোগ দেন ইউপি সদস্য ইব্রাহিম। আশরাফ অভিযোগ করেন, দুদকের এক কর্মকর্তা তার কাছে ১৩ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেছিলেন। ঘুষ না দেওয়ায় ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে তার বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা হয়। পরবর্তীতে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। শুরু হয় দীর্ঘ ফেরারী জীবন।

স্থানীয়দের বক্তব্য

চরফলকনের বাসিন্দা আব্দুস শহিদ বলেন, বিএনপির প্রতি সমর্থন আর জনপ্রিয়তা ছিল বলেই প্রভাবশালী মহল তাকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার বানিয়েছে।
মালেক মাঝি বলেন, হাতে মাইক নিয়ে সাইকেল চালিয়ে প্রচারণা চালানো চেয়ারম্যান আর পাওয়া যাবে না। সততার কারণেই তিনি আজ নিঃস্ব ও ফেরারী।
আরিফ হোসেন, হাসান আলী ও জয়নাল মাঝিও একই মত প্রকাশ করেন—আসল অপরাধীরা বেঁচে গেছে, অথচ গরীবের বন্ধু আশরাফ দুঃখে দিন কাটাচ্ছেন।

পুরস্কার ও স্বীকৃতি

শুধু চেয়ারম্যান হিসেবেই নয়, সাংবাদিক হিসেবেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। চ্যানেল আইয়ের কৃষি সাংবাদিকতা পুরস্কার তিনি গ্রহণ করেছিলেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রধানের হাত থেকে। চিকিৎসক হিসেবেও অসংখ্য মানুষকে বিনামূল্যে সেবা দিয়েছেন।

মামলার বর্তমান অবস্থা

মামলার আইনজীবী মো. আবদুর রহমান জানান, রাষ্ট্রপক্ষ কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। সাক্ষীরা কেউ চাল আত্মসাতের কথা বলেননি। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও মৎস্য কর্মকর্তা আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, দুদকের তদন্তে তাদের বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।
২২ সেপ্টেম্বর মামলার রায় ঘোষণার কথা রয়েছে। আইনজীবীর বিশ্বাস, আশরাফ উদ্দিন অবশেষে সাজানো মামলায় খালাস পাবেন।

তিনি বলেন, “দল, টাকা আর পেশীশক্তি ছাড়া নির্বাচনে জয়ী হওয়া মানেই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। জনগণের ভালোবাসায় জয়ী হয়েছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবকিছু হারালাম—সংসার, পরিবার, চাকরি, শান্তি কিছুই নেই।”